মাহবুব মাসুম:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে এখন রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের দাবি উঠেছে জোরেশোরে। বিভিন্ন নাগরিক প্ল্যাটফর্মে এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। সেখানে অংশ নিচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন চিন্তার মানুষজন। রাজনৈতিক সচেতন তরুণদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আলাদা কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কারের দাবির মধ্যে একটি আলোচনা প্রাধান্য পাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও এ নিয়ে আলাপ উঠেছে।
বাংলাদেশে একটি সরকার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পথ আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। কারণ, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী অসীম ক্ষমতা উপভোগ করেন, শাসন বিভাগের নেতৃত্বের পাশাপাশি আইনসভায়ও থাকে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ক্রমান্বয়ে অপর বিভাগ, অর্থাৎ বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণও প্রধানমন্ত্রীর হাতেই চলে আসে, সঙ্গে আগে থেকে দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ তো থাকেই। ক্ষমতার অসীমতা এতটাই বিপুল হয় যে সমর্থকেরা একসময় প্রধানমন্ত্রীকে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে ‘অবতারের’ মতো ক্ষমতাশালী মনে করেন, ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করেন ও বিপুল আনুগত্য পান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়েই স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন। ভ্যারাইটি অব ডেমোক্র্যাসির ইনডেক্স অনুসারে, বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বৈরাচারী দুটি শাসনামলের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বৈরশাসনের কঠোরতায় শেখ হাসিনা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন আশির দশকের সামরিক শাসকদেরও।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে সংকুচিত করার প্রস্তাব জোরেশোরেই আলোচিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ভাগাভাগি করার প্রস্তাব এসেছে। আলোচনায় এসেছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ করে রাখার প্রস্তাবও। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের ধারণা কোনো নিখুঁত প্রস্তাব নয়।
প্রধানমন্ত্রিত্বের ধারণা যে দেশ থেকে এসেছে, সেই যুক্তরাজ্যে কনজারভেটিভ পার্টি ২০১৯ সালে ৩৬৫ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পার্লামেন্টে আসে। প্রধানমন্ত্রী হন কনজারভেটিভ পার্টিকে নেতৃত্ব দেওয়া বরিস জনসন। ২০২২ সালে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, পার্টিগেট কেলেঙ্কারি আর ক্যাবিনেটে প্রভাবশালীদের অসহযোগিতায় পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী বরিস। দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন লিজ ট্রাস। ৪৫ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয় লিজ ট্রাসকেও। তাঁর জায়গায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ঋষি সুনাক।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের কথাও উল্লেখ করা যায়। রাষ্ট্রপতি প্রথমে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান ১৬১ আসন পাওয়া বিজেপিকে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন অটল বিহারি বাজপেয়ী। আদর্শিক কারণে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো বিজেপির সঙ্গে জোট গঠনে অস্বীকৃতি জানালে অটল বিহারি বাজপেয়ীকে পদত্যাগ করতে হয় ১৩ দিনের মাথায়।
এরপর কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে জনতা দল আর কমিউনিস্ট পার্টিসহ ১৩ দলের ইউনাইটেড ফ্রন্ট। সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন এইচ ডি দেবগৌড়া। প্রধানমন্ত্রী গৌড়া কংগ্রেসের সমর্থন হারানোয় ১৯৯৭ সালের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন আই কে গুজরাল।
গুজরাল সরকারও স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়। নতুন সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেওয়া হয় ১৯৯৮ সালের শুরুতেই। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ফেরেন বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ী।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রিত্বের দুই মেয়াদের কথা বলা হচ্ছে প্রতি সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদকে ভিত্তি ধরে। এর প্রধান কারণ, আমরা যে সময় থেকে দেশে গণতন্ত্র দেখছি, সে সময় থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরা সাধারণত পাঁচ বছরই নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাজ্য কিংবা ভারতের উদাহরণ থেকে আমরা দেখি, পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় সরকার কম স্থিতিশীল হয়। ফলে দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্ব আসলে কখনোই ১০ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সম্ভবত এটা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় সংবিধানের সমালোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল রাখা।
নিশ্চিতভাবেই মেয়াদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কাঠামোগত সংস্কার। শাসন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে পুরোপুরি আলাদা করা। আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাহী বিভাগের মন্ত্রিত্ব করলে আইন বিভাগ কীভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করবে? ফলে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা বণ্টনব্যবস্থা পরিবর্তন করা।
পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশে গণতন্ত্র আছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ এখন সরকার গঠনে ভোট দেয় বা নিয়মিত মতামত প্রদান করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বায়ন হলেও জাতিরাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্রায়ণ করেছে নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক কাঠামোকে সামনে রেখে। এরপরও গণতান্ত্রিক দেশগুলো কিছু মৌলিক মূল্যবোধ অনুসরণ করে এবং অপরাপর দেশের উদাহরণ নিজের দেশে প্রয়োগ করে।
সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে এ রকম বেশ কিছু দেশে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করা নেই। কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত আর অস্ট্রেলিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের উদাহরণ। এসব দেশে প্রধানমন্ত্রীরা যত দিন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেন, তত দিন প্রধানমন্ত্রী থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ আট বছর দায়িত্ব পালনের সীমারেখা টেনে আইন এনেছিল নেসেটে। মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কায়ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনো দেশেই এটি সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়নি।
বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসকের সর্বশেষ উদাহরণ শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসীম নির্বাহী ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধী দল আর মতকে নির্মূল করা শুরু করেন। কাউকে সুবিধা আর কাউকে নিপীড়ন করে একক আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। জনতুষ্টিবাদী প্রচারণা আর জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা, গুম, সহিংসতা, বিচারিক হয়রানি চালানো হয়েছিল। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আর দেশবিরোধী চুক্তি হয়েছে একের পর এক।
ফলে মেয়াদ সীমাবদ্ধ করে দিয়ে এই প্রক্রিয়া আটকানো যাবে না। ফেডারেল কাঠামোর মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা না হলে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে দিলেও দুই বিভাগের নেতৃত্ব থাকায় এই ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে প্রতিনিয়ত।
যুক্তরাষ্ট্রে আমরা দেখি, প্রেসিডেন্টদের নির্বাহী ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন প্রেসিডেন্টের আমলে ক্ষমতার সংহতিকরণ পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে ধারাবাহিকতার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ফেডারেল কাঠামো সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা হস্তান্তরের অস্থিতিশীলতা সামাল দিতে পেরেছে।
ফলে নিশ্চিতভাবেই মেয়াদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কাঠামোগত সংস্কার। শাসন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে পুরোপুরি আলাদা করা। আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাহী বিভাগের মন্ত্রিত্ব করলে আইন বিভাগ কীভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করবে? ফলে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা বণ্টনব্যবস্থা পরিবর্তন করা।
বাংলাদেশ অন্যান্য সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশের মতো ওয়েস্টমিনস্টারিয়াল ফরম্যাট অনুসরণ করে। রাজার আদলে এখানে থাকেন রাষ্ট্রপ্রধান, আলংকরিক রাষ্ট্রপতি; সরকার চালান প্রধানমন্ত্রী। আবার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্র আর সরকার, দুটিরই নেতৃত্ব দেন প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অনুসরণ করা অধিকাংশ দেশই যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সীমাবদ্ধ করেছে।
প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সীমিত করে দেওয়ার বিধান ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে তুলনামূলক ভালো ভূমিকা রেখেছে, সেটিই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ কিংবা রাষ্ট্রচিন্তকদের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করে দিতে আগ্রহী করছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশেই এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ নির্দিষ্ট করার ধারণা প্রয়োগ হয়নি। এর ফলে আমরা এটির নিশ্চিত ফলাফল বলতে পারি না।
কিন্তু সরকারপ্রধানের জন্য মেয়াদ নির্দিষ্ট করার ধারণা অত্যন্ত ইতিবাচক। বাংলাদেশে সরকারপ্রধানের এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে সেটি প্রেসিডেন্ট শাসিত ফেডারেল কাঠামোতে গিয়েই করা উচিত।
সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনো দেশেই জনগণ সরাসরি সরকারপ্রধান নির্বাচন করতে পারেন না। স্থানীয়ভাবে ভোটাররা সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন, তাঁরা (সংসদ সদস্যরা) সরকারপ্রধান নির্বাচন করেন। ফলে সরকারপ্রধান নির্বাচনে ভোটারদের ‘অ্যাকটিভ চয়েস’ দেওয়ার সুযোগ যেমন নেই, সরকারপ্রধান পরিবর্তন হলেও তাতে মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই।
সংসদের মেয়াদের মধ্যে সংসদ সদস্য দল পরিবর্তন করলেও সেটিতে জনগণের মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন, তা নিয়ে জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেট দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত এবং সেটি রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা দেয়।
প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে, কেবল জাতিগত বৈচিত্র্য থাকলেই ফেডারেল কাঠামোতে যাওয়া উচিত। কিন্তু ফেডারেল কাঠামোর অন্যতম উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনের বিতর্কগুলো দেখলে আমরা বুঝতে পারব, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামো তৈরির উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা, বিভিন্ন অঞ্চলের নাগরিক চাহিদা অনুযায়ী বেশি মানানসই নীতি প্রণয়ন করা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা। এই কারণগুলোই সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারী শাসনের পরে বাংলাদেশের জন্য ফেডারেল শাসনের প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করে।
আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারবে, রাষ্ট্রকাঠামোতে নাগরিকদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়বে। যুক্তরাজ্যে যেখানে গড়ে প্রতি এক লাখ মানুষকে একজন সংসদ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা পৌনে ছয় লাখ। ফেডারেল কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিত্ব বাড়ায় ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতীকরণ আটকাবে।
ফেডারেল কাঠামো ঢাকার ওপর চাপ কমাবে, জনসংখ্যার ভারে ইতিমধ্যেই নুইয়ে পড়া এই শহরে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও আইন প্রয়োগের কার্যক্রমগুলো প্রাদেশিক সরকারে কাছে চলে যাবে, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র তৈরি হবে। আশা করি, সামাজিক ও রাজনৈতিক আশঙ্কাও কমবে।